অফবিটচাকরি ও শিক্ষাসাহিত্য ও সংস্কৃতি

ওরা হারিয়ে যাচ্ছে! আইনের ফাঁকে বাল্য-বিবাহ

কলমে - প্রিয়াঙ্কা কর এবং ভুবন মোহনকর

ওরা হারিয়ে যাচ্ছে! আইনের ফাঁকে বাল্য-বিবাহ

 

নিজস্ব প্রতিবেদন: প্রিয়াঙ্কা কর এবং ভুবন মোহনকর : ০৬/০৭/২০২২: সময় স্রোতের ন্যায় বহিয়া যায়। কালের নিয়মেই আমরা দাঁড়িয়ে আছি এখন একবিংশ শতাব্দীতে, যে সময়ে মানুষ মানুষের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয় প্রযুক্তিতে ; যার কুফল ও সুফল দুই প্রভাব লক্ষণীয়। সেই পটভূমিতে

আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় বাল্য-বিবাহ সরাসরি বাল্য বিবাহের সহিত প্ৰযুক্তি ব্যবহারের সম্পর্ক না থাকলেও পরোক্ষভাবে নিশ্চিত আছে।

    বাল্য বিবাহ

এই বিষয়টি যে এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এখনো প্রচলিত তা ভাবতেই আমাদের অনেকেরই নাভিশ্বাস উঠবে। কিন্তু, NFHS-4 (২০১৫-১৬) এর রিপোর্ট বলছে পশ্চিমবঙ্গে চাইল্ড ম্যারেজ ছিল ৪১.৬ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে ও শহরাঞ্চলে। কিন্তু, NFHS-5 (২০১৯-২০) এর রিপোর্ট বলছে পশ্চিমবঙ্গে বাল্য বিবাহের হার বেড়ে হয়েছে ৪৮.১ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে ও ২৬.২ শতাংশ শহরাঞ্চলে। আঠারো বছরের নীচে মেয়েদের ও ২১ বছরের নীচে ছেলেদের বিবাহকেই আইনের ভাষায় বাল্য বিবাহ বলা হয়, একথা আমাদের অধিকাংশেরই জানা কিন্তু তা সত্ত্বেও চাইল্ড ম্যারেজের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। বাল্য বিবাহ অবশ্যই কিছুটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে কিন্তু তবুও এই বর্ধনশীল বাল্য বিবাহের হার সমাজের জন্য ব্যাধি।

প্রচুর আইন, অনেক ডিপার্টমেন্ট বিভিন্ন ভাবে চাইল্ড ম্যারেজ আটকানোর চেষ্টা করলেও সর্বাংশে তা কখনোই সম্ভব হচ্ছে না তাই করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে অগুনতি চাইল্ড ম্যারেজের খবর পাওয়া যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। পুলিশ প্রশাসন , চাইল্ড লাইন, ডি. সি. পি.ইউ, আই. সি.ডি. এস, এন.ওয়াই.কে ইত্যাদি সরকারি দপ্তর ছাড়াও বিভিন্ন এন.জি.ও সমাজের এই ব্যাধিকে প্রতিহত করার জন্য নিরন্তর কাজ করে চলেছে কিন্তু তার মধ্যেও কিছু গাফিলতি অবশ্যই চোখে পড়ার মত। সাম্প্রতিক দুটি ঘটনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি, তাহলেই বুঝবেন গন্ডগোল টা কোথায়? আসলে সাধারণ নাগরিক বনাম প্রশাসন দুজনেই অ-সচেতন। এক পক্ষ বোঝে নিজের স্বার্থ, আরেক পক্ষ স্রেফ নিজের দায় এড়াতে চায়।

ঘটনা-১ :

পশ্চিম মেদিনীপুর কেশপুর ব্লকের ঘটনা। সময়টা ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি। একটি খবর আসে কিশোরী (নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে, রূপা), রূপার বয়স ১৫ বছর। রূপা কিশোরী সমুহ এবং কন্যাশ্রী ক্লাবে গিয়ে জেনে গিয়েছে ১৮’র আগে বিয়ে করা অপরাধ। তার থেকেও বড় কথা সে এখন পড়তে চায়। তাই সে তার এক বান্ধবীকে দিয়ে খবর পাঠায়, যেনো তার বিয় টা আটকানো হয়। বাল্য বিবাহের কথা শুনে যথারীতি প্রশাসন সেখানে উপস্থিত হয় এবং বিয়টা আটকানো যায়। যদিও কাউকে অ্যারেস্ট করা হয়নি। কিন্তু সে বিয়ে আটকাতে পুলিশ প্রধানকে যথেষট বেগ পেতে হয়। এখানে রূপার বুদ্ধি ও সাহস প্রশংসনীয়। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল অভিভাবক রা কেন সচেতন নয়? এত প্রচার, প্রকল্প, আইনের বাধা না মেনে কেনো অজ্ঞের মত কাজ? সব মেয়ে কি পারবে রূপার মত সাহসিকতা দেখাতে?

 

ঘটনা-২

সাম্প্রতিক আরও একটি ঘটনা যেখানে দেখলাম প্রশাসনের গাফিলতি। ঘটনাটি সবংয়ের। বিয়ের দিন সকালে খবর আসে একটি ১৪ বছরের কিশোরীর বিয়ে হচ্ছে (নাম পরিবর্তন – মীনা)। মীনার সঙ্গে যে ছেলেটির বিয়ে হচ্ছে তার বয়স ২১। যথারীতি খবর পেয়ে চাইল্ড লাইন এবং প্রশাসনে খবর জানানো হয়। মেয়েটির বিয়ে যাতে না ভেস্তে যায়, তার জন্য মেয়েটিকে ছেলের বাড়ি এনে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক পরে পুলিশ পৌঁছোয় সেখানে, নামমাত্র একটি মুচলেকা নেওয়া হয় যে বাল্য বিবাহ দেওয়া হবে না। পরে সেই বাল্য বিবাহ টি হয়ে যায়। আপনারাই বলুন একটা সাদা কাগজে মুচলেখা নিয়েই কি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? আবার অনেক জায়গা থেকে এমন খবর ও আসে, সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার, যাদের ওপর নাকি অনেক দায় দায়িত্ব, তারা বিয়ের প্রাঙ্গণে গিয়ে বিজ্ঞের মত জানান দেয় যে, বাল্য বিবাহ হোক বা না হোক বাইরের লোকের মাথা ব্যথা কেনো? তাদের কি কোনো শত্রু আছে, যারা এই বিয়েটা ভাঙতে চায়? পাত্র-পাত্রীর বাড়ির লোকেরা যেনো অন্য কোনো জায়গায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে টা চুপিসারে দিয়ে দেয়, বাকিটা তারা ম্যানেজ করে নেবে। তাহলেই বুঝুন এত প্রচার, প্রকল্প, সচেতন শিবিরের মানে টা কি থাকলো? সচেতনতার দরকার কাদের? জন সাধারণ নাকি দপ্তর প্রশাসনের?

আরও একটি বড় সমস্যা সেটি হল রাজনৈতিক মদত। যেখানে প্রশাসনের সহযোগিতায় কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেখানেই রাজনীতি এসে উঁকি দিয়েছে। সেটা নাহয় খুলে নাই বা বললাম। বুঝে নিন। এবার বেশ কিছু সময় এমন অভিযোগ ও আসে চাইল্ড লাইন নিরুদ্দেশ। এই সংস্থা এত ফলাও করে বিজ্ঞাপন দেয়, এত ক্যাম্প করে, আলোচনা সভার আয়োজন করে, কিন্তু কাজের বেলায় ফাঁকি। তাহলে মানুষের আস্থা কোথায়? ওই বাচ্চা গুলো যারা এই আলোচনায় সভা গুলো মন দিয়ে শোনে, ১০৯৮ নং টা কাগজে টুকে নিয়ে যায় সাহায্য পাবে এই আশায় তাহলে তাদের কি হবে? সচেতনতা বৃদ্ধিতে হোক কিংবা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে হোক ; যার ফলস্বরূপ বাল্যবিবাহের সংখ্যা কমার পরিবর্তে দিন দিন বেড়েই চলেছে।

প্রত্যেকটি প্রাণ একটি রাষ্ট্রের জন্য মূল্যবান আর তাই শুধুমাত্র যারা এই কর্মের সাথে যুক্ত আছে তারা নয় প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব যারা আজকের শিশু ও কালকের দেশের ভবিষ্যৎ ; তাদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চত করা। নাহলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে, মানুষ আমাদের ওপর বিশ্বাস হারাবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page

Adblock Detected

Please Turn Off Your Ad Blocker.