অফবিটসাহিত্য ও সংস্কৃতি

মহাসমারোহে মহাভারতের মধ্যম পাণ্ডব ভীমের আরাধনা ও মেলা লোকসংস্কৃতির লৌকিক উপাদান , পাশাপাশি পুরাণের ভীম একাদশীর ইতিহাস

মহাসমারোহে মহাভারতের মধ্যম পাণ্ডব ভীমের আরাধনা ও মেলা লোকসংস্কৃতির লৌকিক উপাদান , পাশাপাশি পুরাণের ভীম একাদশীর ইতিহাস

——————————————————————–

শ্যামা পদ প্রামাণিক, রসিকগঞ্জ: সব পুজো ও পার্বণের ইতিহাস লোকাচার ঐতিহ্য আছে। ভীম পুজো ও ভীম একাদশী এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয় নানা রকম ইতিহাস সংস্কৃতি জড়িয়ে আছে।দুই জেলা পূর্ব পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামে ভীম পূজা ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে হয়। ঝাড়গ্রামে,নয়াগ্রামে ও বিশেষত পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদল, তমলুক, কাঁথি,কুলবেড়িয়া একমাস ব্যাপী ভীমপুজো উপলক্ষে ও হরেকরকম অনুষ্ঠান হয়। ঘাটাল শহরের বিভিন্ন স্থানে, এই মহকুমার বিভিন্ন স্থানে ও দাসপুর থানার দাসপুর, রসিকগঞ্জ, নিমতলা, লাওদায় সিমেন্টের তৈরী স্থায়ী ভীম মূর্তি তে পুজো হয়।

অবশ্য ভীমের পুজো খোলা আকাশের নিচে রাস্তার ধারে হয় সর্বত্র। রসিকগঞ্জ ভীমের পুজো প্রাচীন পুজো। ৫০থেকে ৬০বছর পূর্বে শুরু হয়।

ভীমপুজো নানা কিংবদন্তি, লোকাচার ও ইতিহাস:

——————————————————————–

কোন‌ গ্রামে এই পুজো তাদের গ্রামে প্রধান পুজো রূপে তারা মেতে ওঠে। কোন কোন গ্রামে কৃষির দেবতা হিসেবে ঘটা করে পুজো করে। সংসারে শান্তি ও সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনা করে ও মনস্কামনা পূরণের পর টাকার মালা দিয়ে ভীমের পুজো দেয় অনেক পরিবার।

প্রাচীনকালে ব্যবসায়ীরা পবন নন্দন কে সন্তুষ্ট করতে। পণ্যবাহী জাহাজ সমুদ্রে যাতে জলদস্যুরা পণ্য সামগ্রী লুট না করতে পারে এবং ঝড়ের হাত থেকে নিরাপদে জাহাজ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। তার জন্য ব্যবসায়ীরা পুজো করে জাহাজ ছাড়ত।

পুরাণ থেকে জানা যায় ও জনশ্রুতি মহাভারতের পাণ্ডবরা বনবাসকালে দক্ষিণবঙ্গে বেশ কয়েকটি স্থানে বসবাস করত। যেমন ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন স্থানে । জনশ্রুতি এখানে ষাটিদহে দ্রৌপদী রন্ধনের জন্য একটি পুকুর থেকে জল নিয়েছিল।

পান্ডবদের নিয়ে এক কিংবদন্তি আছে উৎসবের শেষ দিন গোপীবল্লভপুর এর বালিঘাতে এক গ্রামে যুধিষ্ঠির পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করেছিল। সুবর্ণরেখার তীরে পাণ্ডবেরা বসতবাড়ি নির্মাণ করেছিল।

এখানের কিছু পড়ে থাকা পাথরকে অনেকে ভীমের পা বলে মনে করে।সেই হিসেবেও দ্বিতীয় পাণ্ডবের ও কোথায় বলশালী দেবতা রূপে পুজো হয়। দুই জেলাতে ভীম পূজা উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ,ডান্স হাঙ্গামা ও বাউল যাত্রা গান হয়।

ইন্দোনেশিয়ায় ভীমকে শ্রমিক শ্রেণীরা তাদের শরীর সুস্থ রাখার জন্য ও শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখতে বলশালী দেবতা ভীমের আরাধনা করে। তারা তাদের এই দেবতার কাছে প্রার্থনা করত।কৃষক সম্প্রদায় ভীমকে রূপে পুজো করে দেবতারূপে।

 

প্রাচীন ঐতিহ্য ভীমপুজো ও মেলা যেসব স্থানে হয়:

——————————————————————–

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রামের নন্দকুমারের টেবাগেড়া গ্রামে ৩০০ বছরের মেলা হয়। হাওড়া জেলার শ্যামপুর থানা রাধাপুরে প্রাচীন মেলা দাসপুর থানা চেতুয়া রাজনগর , রাধাকান্তপুর, চাঁদপুরে, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়মালে সাত দিনের প্রাচীন মেলা ও বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। নয়াগ্রামের খড়িকাগ্রামে ভীমপুজঝ ও মেলা হয়।

ভীমপুজো পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনীর গড়মালে এই গ্রামের প্রধান উৎসব। ৭৭ বছর পরেও জৌলুস এতটুকু কমেনি। পুজোর সাত দিন পূর্বে এই গ্রামে ঘরে ঘরে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। ভাঙাচোরা ঘরগুলি মেরামত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। দেওয়ালগুলি রং করে গৃহবধূরা ঘরের দেয়ালে আলপনা দিয়ে সুন্দর অলংকরণ করে।পুজোর আগের দিন থেকেই ঘরে আত্মীয়-স্বজনের আগমনে জমজমাট হয়ে উঠে। এই গ্রামের কয়েকজন যাত্রাপাগল এই ভীমপুজোর সূচনা করেন। জানা গিয়েছে দুর্গাপদ চক্রবত্তী ,ভবসিন্ধু ভান্ডারী সনৎ ভান্ডারী ছিল বিশাল যাত্রা করার নেশা। প্রতিবছর নিজের গ্রামে ও পাশাপাশি গ্রামে যাত্রা করত। যাত্রা করে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছে এবং এঁরা ঠিক করে। বলশালী ভীমের পুজো করে তার আদর্শ প্রচার করবেন। এবং ভীমপুজো করে যাত্রা করবেন।‌সেইমত শালবনীর গেঁড়েমালে ৭০-৮০বছর পূর্বে ভীমপুজোর সূচনা করেন ভান্ডারী ও চক্রবত্তী প্রমুখেরা।

পূর্ব মেদিনীপুরে ব্যবত্তারহাটে মহাভারতের মধ্যম পান্ডব ভীমের মহাসমারোহে আরাধনা ও মেলা হয়। দেবতার মর্যাদায় হাজার হাজার টাকার মেলা টাকার মালা পরানো হয়। এখানে ভীমকে বহুদূর গ্রামের মানুষ পুজো দিতে আসে। কেউ আসে ভীমের কাছে মনের বাসনা পূরণ করতে কেউ আসে মনস্কামনা পূরণের পর পুজো দিতে। টাকার মালা ও বাতাসা দিয়ে পুজো দেয়। এখানে মন্দির থেকে মন্দিরের কুন্ডু থেকে দন্ডি কেটে ভীমের কাছে মানত করার রীতি প্রচলিত। সূত্রে জানা গিয়েছে প্রণামীর টাকায় মন্দিরের উন্নয়ন ছাড়াও গ্রামীণ নানা সেবামূলক কাজে দেওয়া হয় ।পূজা উপলক্ষে সাত দিনব্যাপী মেলা যাত্রা সহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেলা প্রাঙ্গণ জমাট হয়ে ওঠে।

 

ভীম একাদশী কী ও কেন?

————————————————

 

ভীম একাদশী নিয়ে অনেক কাহিনী শোনা যায় যে কাহিনী বহুল প্রচারিত। তাদের মাতা কুন্তী দেবী মাঘ মাসের শুক্লা একাদশী দিন একাদশীর দিন শীতের সকালে পুকুরে স্নান করে একাদশী ব্রত পালন করত। ঐদিন ভীম তার মাকে বিশাল ঠান্ডা স্নান করে আসার পর। ঠাণ্ডায় কাঁপতে দেখে। দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন ও শীতের প্রতি ভীষণ রাগ হয়। মায়ের এই অবস্থা থেকে স্বস্তি দেওয়ার জন্য ভীম একটি লোহার নাঙ্গলের ফালকে আগুনে কসকসে গরম করে। সেটি পুকুরে ডুবিয়ে দেয় আর সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের জল গরম হয়ে যায় কুন্তি দেবী সেই গরম জলে স্নান করে ঠান্ডা লাঘব হয়। জল প্রচন্ড গরম হয়ে যায় বরুনদেবের গা পুড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় । তখন দ্বারকায় গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে এই ঘটনা সবিস্তারে জানালেন। তাকে বলেন যে ভীমকে বুঝিয়ে নির্জলা উপবাসে থেকে একাদশী করতে। সেইমতো বরুণদেবকে বুঝিয়ে মাঘ মাসের শুক্ল একাদশী ব্রত পালন করে। সেই থেকেই এই একাদশীকে ভৈমী একাদশী হিসেবে বলা হয়।

শিবায়ন কাব্যে থেকে জানা গিয়েছে শিব দেবতা হালুয়া ভীমের সহযোগিতায় ত্রিশূল ভেঙে লাঙ্গলের ফলা নির্মাণ করেছিলেন। ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে একটি গ্রামীণ লোক ছড়ায় পাওয়া গিয়েছে

” মেদিনীপুরের হালুই ভীম / ভীম হুড়া চাষী / তাই ভীম একাদশী

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page

Adblock Detected

Please Turn Off Your Ad Blocker.