পিংলার পটচিত্র আজ আন্তর্জাতিক বাজারে খ্যাতিসম্পন্ন
সব্যসাচী গুছাইত,২৮/১২/২০২২ : পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলা ব্লকের পটের গ্রাম বললেই নয়া গ্রামের কথা একবাক্যে স্বীকার করে নিতে হয়। এখানে প্রতিটি পরিবার চিত্রশিল্পের সাথে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছে।
মাটির বাড়ির নিকোনো দেওয়াল যেন হঠাৎই হয়ে উঠেছে ক্যানভাস— বাঙলার মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দোগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহযোগীতায় বর্তমান বছরে গত ২৩ শে ডিসেম্বর থেকে পটচিত্র মেলার উদ্ভোদন হয়। শিল্পীর রঙিন হাতে বিচিত্র তার রূপ। একে একে রঙে ভরে গিয়েছে কুঁড়ে ঘরগুলি। মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন পটচিত্রের গল্পে সাজিয়ে তোলা হয়েছে প্রতিটি বাড়ির দেওয়াল।
তা ছাড়া পটচিত্রের নিজস্ব অঙ্কন রীতিতে রঙিন হয়ে উঠছে শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, টি শার্ট, ছাতা, হাতপাখা, হ্যান্ড-ব্যাগ বা ট্রে, ঘর সাজাবার নানা উপকরণ। প্রতিটি বাড়ির দাওয়ায় রয়েছে বিকিকিনির আয়োজন। আছে কর্মশালাও। তৈরি হয়েছে একটি মঞ্চ। সেখানে চলছে বাউল গান, ছৌ নাচ-সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন।
পটুয়াদের জীবন ও শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এ এক দারুন সুযোগ। শুধু মেলার সময়ই নয়, বছরভর দেশ বিদেশের মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে এই পটুয়া পাড়ায়।
২০১০ সালে ‘বাংলা নাটক ডট কমে’র উদ্যোগে প্রথম শুরু হয়েছিল এই পটমেলা। ৮৬ টি পরিবারের ২৭০ জন পটুয়াদের নিজস্ব সংগঠন “চিত্রতরু” এবং সহযোগীতায় পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ। যদিও বর্তমান সময়ে সেই সংখ্যাটা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউনেসকোর সহায়তায় পটশিল্পের Rural Craft Hub গড়ে উঠেছে এখানে। এখানে একটি পটশিল্পের সংগ্রহশালা, প্রতি বাড়িতে গ্যালারি এবং অতিথি নিবাস তৈরি করা হয়েছে।
নির্দিষ্ট কোন কাহিনীকে ভিত্তি করে পট আঁকা হয়। পৌরাণিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক বা সাম্প্রতিক ঘটনা পটের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। রামায়ণ, মহাভারত, চন্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গলের মতো কাহিনীগুলিকে পটুয়ারা মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। সেইসঙ্গে বর্তমান দিনের বন্যা, দুর্গা পূজা, পালস্ পোলিও, ডেঙ্গু, এডস্, কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, যুবশ্রী, বনভূমি ও বন্যপ্রান রক্ষা সহ আরো নানান সচেতনতামূলক প্রচার পট চিত্রের মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে।
পটের ছবির কাহিনীটিকে গান গেয়ে বর্ণনা করেন পটশিল্পীরা। ছবি ও সুরে জীবন্ত হয়ে ওঠে বিষয়। এই শিল্প কর্মের সঙ্গে মূলতঃ মহিলারাই যুক্ত। পটচিত্রে যে রঙ ব্যবহার করা হয় সেগুলি বিভিন্ন গাছপালার প্রাকৃতিক উপাদান থেকে শিল্পীরা নিজে হাতে তৈরী করেন। তাই রঙ তৈরীর পদ্ধতিটিও একটি দর্শনীয় বিষয়।
১৫-২০ বছর আগে পটিদার মানে পটশিল্পীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে পটের গান শুনিয়ে বেড়াতেন। গান শুনে কেউ দিতেন টাকা, কেউ আবার চাল-ডাল। আর এখন গ্রামের চেহারা বদলে গিয়েছে। পট শিল্পীদের রোজগার বেড়েছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, সন্তানদের এই গ্রামের শিল্পীরা পটুয়াই বানাতে চান। সেই লক্ষ্যে প্রতি রবিবার নিয়ম করে পট আঁকার ক্লাস বসে। তাতে যেমন গ্রামের কচিকাঁচারা যোগ দেয়, তেমনই আশেপাশের গ্রামের লোকও আসে। অনেক শিল্পী রাজ্য সরকারের পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে পটচিত্র।
কলকাতার বেশ কয়েকটি বুটিকের কর্ণধাররাও এখানে এসে নিয়ে যান অর্ডার মাফিক পোশাক।
পটুয়াদের হাতের কাজ দেখার অভিজ্ঞতা। এমনকী শিল্পীদের সঙ্গে থেকে শিখে নিতে পারবেন প্রকৃতি থেকে রং সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াও।