অফবিটশিরোনামে ঘাটাল

ঘাটালের ব্যবসায়ীদের হালখাতার হালচালের বিবর্তনের ইতিকথা – ✍️ শ্যামাপদ প্রামাণিক

ঘাটালের ব্যবসায়ীদের হালখাতার হালচালের বিবর্তনের ইতিকথা

কলমে: শ্যামাপদ প্রামাণিক

ঘাটাল এক প্রাচীন জনপদ।ঘাটাল শব্দের আভিধানিক অর্থ বন্ধুর বা এবড়ো থেবড়ো, অসমতল ( ঘাট + আল) ঘাটাল। এই বন্ধুর প্রাচীন পৌরশহরের নামকরণ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। কোন আঞ্চলিক গবেষকই এর সন্তোষজনক ও সঠিক যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণে এই বিতর্কের অবসান করতে পারেন নি। বিতর্ক আজও রয়ে গিয়েছে। কিন্তু ঘাটালের ব্যবসায়ীদের হালখাতার হালচাল নিয়ে বিতর্ক নেই।

ঘাটাল ব্রিটিশ আমল থেকেই নানা প্রকার ব্যবসা বানিজ্যের আদর্শ কেন্দ্র রূপে বহুল প্রচারিত। জানা গিয়েছে এক সমীক্ষায় প্রতিদিন ঘাটাল কুঠি বাজার সংলগ্ন এলাকায জুড়ে হাজার হাজার টাকার বাণিজ্য হয়। ঘাটালের অন্য এলাকায় তা হয়না।

ব্যবসার ক্ষেত্রে স্থানের গুরুত্ব যথেষ্ট রয়েছে। তাই ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্যরা ঘাটালের কুঠি বাজার সংলগ্ন এলাকায় বা এর আশেপাশে ব্যবসার জন্য এক টুকরো জায়গা খুঁজে। তা জায়াগার মূল্য যতই হোক। ঘাটালের এই ব্যপক বাণিজ্যের জন্য কোন এক উচ্চপদস্থ অধিকারীকে ঘাটাল কে দাঁড়িপাল্লা নিয়ে ব্যবসা করার অন্যতম জনপদ হিসেবে উল্লেখ করেন।

এই জনপদে ব্যাবসা বাণিজ্যই ছিল প্রধান। সেই

প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা পিতল, কাঁসা,বস্ত্র ব্যবসা ভুষিমাল সহ আরো বিভিন্ন মনোহারী, প্রেস, কাগজ বইএর ব্যবসা ইত্যাদি। ঘাটালের শীলাবতী নদীর পশ্চিম পাড়ের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ব্যবসায় প্রচুর টাকা মুনাফা করেছে বলে শোনা যায়।

২. বাংলা নতুন বর্ষের প্রথম দিন ১লা বৈশাখ ও হালখাতা প্রতিটি ব্যবসায়ীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এক অনুভূতি ও অন্যরকম বিশেষ ধরনের নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন। হালখাতার প্রচলন হয় ব্রিটিশ শাসনকালে। হালখাতা শব্দ দুটি আরবি ভাষার সঙ্গে সম্বন্বয়ে আছে। হাল কথার অর্থ চলিত খাতা শব্দের অর্থ হিসাবের খাতা। ব্রিটিশরা বছরের প্রথম দিন জমিদারদের খাজনা দেওয়ার রীতি চালু করেছিল। মুসলিম শাসনকাল থেকেই হালখাতা শব্দটি বাঙালি মননে ও জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এই দিনটি ব্যবসায়ীদের কাছে আগামী এক বছরের তাদের ব্যবসার সমৃদ্ধি ও শুভকামনার মহরতের উজ্জ্বল ও পবিত্র দিন। সর্বাঙ্গীণভাবে এই দিনটিকে সৌন্দর্যময় করতে তারা নানাভাবে নানা অনুষ্ঠানে তৎপর হয়।এই তৎপরতা শুধুমাত্র বর্তমানে নয় অতীতেও ছিল। তখনকার সময়ে পহেলা(১লা) বৈশাখে নতুন খাতা হালখাতার অনুষ্ঠান খুব জমজমাটভাবে ঘাটালের ব্যবসায়ীরা করতেন। বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে ও ক্ষেত্র সমীক্ষায় জানা গিয়েছি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রামেশ্বর মল্লিক, সুধীর পাল, প্রয়াত রাধা নাথ ঘোষ ও হড় পরিবার নতুন খাতার শুভ মহরত রীতিমতো বাড়িতে ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মত করতেন। খরিদ্দার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের আমন্ত্রণ করে পংক্তি ভোজনের ব্যবস্থা করতেন। আবার বাড়ির জন্য শালপাতা বা কাগজের ঠোঙাতে করে মিষ্টান্ন দিতেন। এঁরা তৎকালীন সময়ে বড় ধরনের ঘাটাল জনপদের ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু ছোটখাটো ব্যবসায়ীরাও পিছিয়ে ছিলেন না, তারাও সাধ্যমত হালখাতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন।

বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা (১লা) বৈশাখের পুণ্য প্রভাতে প্রতি ব্যবসায়ীরা ধোপ দূরস্ত পোশাক পরে পরে লাল খেরোর বাঁধা খাতা বা অন্য ধরনের খাতা নিয়ে দেবতার মন্দিরে হাজির হয় বা হয়। খেরোর খাতা মোটা লাল কাপড়ে বাঁধাই করা খাতা জাবেদা খাতা। যে খাতায় থাকে নানা বিষয়ের ব্যবসায়ীদের হিসাবপত্র লেখা থাকে বা লেখা হয়। এই খাতা কে সমৃদ্ধির প্রতীক রূপে পূজা করেন প্রতি ব্যবসায়ীরা। আগামী বছরের দিনগুলি তারা ব্যবসা সুন্দর ভাবে যাতে চলে তারা দেবীর কাছে প্রার্থনা করেন। পুরোহিত মন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে খেরোখাতা পুজো করেন। মন্দিরে ব্যবসায়ীরা করজোড়ে দেবতার কাছে তার দোকানের শুভ সমৃদ্ধির কামনা করেন । ব্যবসায়ীদের নতুন খাতায় সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন, রুপোর টাকার চিহ্ন এঁকে নতুন খাতা বা খেরোর খাতা ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেন। সেই খাতা নিয়ে দোকানে এসে । ব্যবসায়িক লেনদেনের শুভ আরম্ভ করেন বা কেনা বেচা শুরু করেন।

সারা বছরের খরিদ্দাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে পুরানো ধার দেনা শোধ করে নতুন খাতায় নতুন বছরের হিসেব নিকেশে শুভ সূচনা হয়।লাল কালি শুভ তাই লাল রঙের কালিতে। ওই খাতায় হিসাবপত্র লেখা হয়। সারাদিন ও রাত্রে বিগত সনের খরিদ্দারদের বাকি টাকা জমা করেন হত বা হয় নতুন খাতায়। তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা থাকত পান, বিড়ি, সিগারেট শরবত ইত্যাদি। কাগজের ঠোঙায় তাদের বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার জন্য দেওয়া হত। ক্যালেন্ডার দেওয়ার তখন রেওয়াজ ছিল না।তখনকার দিনে খরিদ্দারদের আমন্ত্রণ পত্র দেওয়া হতো না। দোকানদাররা সাধারণ সাদা কাগজ বা রঙিন কাগজে ১লা বৈশাখে হালখাতার অনুষ্ঠানের মানপত্র আমন্ত্রণ পত্র পাঠাত। অনেক ব্যবসায়ী অনেক ব্যবসায়ীরা পুরোহিতদের ও আচার্যীদের নতুন পঞ্জিকা উপহার দিতেন।

সময়ের পরিবর্তন হয়েছে , হয়েছে হালখাতার নিয়মের পরিবর্তন ও। ঘাটাল জনপদটি বর্তমানে পৌরসভা। এই পৌরসভার বয়স আড়াইশো বর্ষের বেশী। ঘাটালের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও ঘাটালের হালখাতার আঙ্গিক ও পদ্ধতির পরিবর্তনের হয়েছে। দেবদেবীর মূর্তি সমন্বিত কার্ড কিনে ।কেউ আবার কাব্যিক ছন্দে নিমন্ত্রণপত্র পাঠান। অনেক দোকানদার তার দোকানের খরিদ্দাদের। কেনাকাটি দোকানের নাম স্ট্যাম্প লাগিয়ে আমন্ত্রণপত্র পাঠায় তার খরিদদারদের। পূর্বের মত বাড়িতে ভাত খাওয়ানোর রীতি নেই ।দোকানে খরিদ্দার খরিদ্দারেরা দলে দলে আসেন। ঠান্ডা পানীয়, বেল দই এর শরবত এবং প্যাকেটে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। খরিদ্দার এর বাকি টাকা মিটিয়ে দেয়। অনেক দোকানে তাদের দোকানের নামে চাবির রিং ক্যালেন্ডার ,ডায়েরী, সুদৃশ্য ব্যাগ, মিষ্টির প্যাকেট উপহার দেয় । এই দিনটিতে দোকানে দেবদারু পাতা ও অত্যাধুনিক ভাবে প্লাস্টিক বা ফাইবারের ফুল দিয়ে দোকান কে সুন্দর ভাবে সাজায় ।বক্সে সুন্দর সুন্দর পুরানো ও বর্তমানের আধুনিক গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত ইত্যাদি সংগীত বাজে। তাতে দোকানের পরিবেশ বদলে যায় । অতীতে আমন্ত্রিত অতিথিদের হাতপাখা দেয়ার চলছিল। বর্তমানে ইলেকট্রনিক বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবস্থা থাকে। হালখাতা বা খেরোর খাতার পরিবর্তন ঘটেছে। প্রাচীনকালে মোটা ও দামি কাগজে টেকসই বা দামি কাপড়ে জড়িয়ে তৈরি হতো এই হাল খাতাবা খেরোর খাতা বর্তমানে তা বদলে খরচ কমাতে সাধারণ লাল শালুর কাপড় জড়িয়ে এই খাতা তৈরি হচ্ছে। একদিন এই পদ্ধতিও হারিয়ে যাবে কালের নিয়মে। তবে প্রাচীনকালের মত বর্তমানে পহেলা (১লা) বৈশাখে দোকানে দোকানে গিয়ে মিষ্টি খাওয়া ও মিষ্টির প্যাকেট, ক্যালেন্ডার সংগ্রহের সংগ্রহের প্রতি মানুষের আগ্রহ বা আত্মিক টান অনেকটাই কমে গিয়েছে।

বর্তমানে সময়ের বদল ঘটেছে ইলেকট্রনিক দ্রব্যের ছড়াছড়ি। সরাসরি হাতে হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের দৌরাত্ম্য। অনেক ব্যবসাদার কম্পিউটারে ব্যবসার হিসাব রাখেন। মোবাইলেও হিসাব হচ্ছে। আরও কয়েক দশকের মধ্যে অনেক নিত্যনতুন হিসেবে প্যাকেজ আসবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের হালখাতা রূপায়নণের কোন পরিবর্তন হবে না। প্রতি বছর পহেলা১লা) বৈশাখে পুরানো কে বিদায় জানিয়ে নতুন কে আহবান জানানোও ব্যবসাদাররা তাদের ব্যবসার সমৃদ্ধির লক্ষ্যে দেবতার মন্দিরে পুজো দেওয়া বন্ধ হবে না। কিন্তু আরো কয়েক শতাব্দী পরে ।খেরোর খাতা বা হালখাতার হালচাল আরো বিবর্তনের পথে পা বাড়িয়ে বিস্মৃতির অতল তলে তলিয়ে যাবে কিনা কে বলতে পারে?

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page

Adblock Detected

Please Turn Off Your Ad Blocker.