অফবিট

ধনতেরস থেকে কালীপূজা- স্বামী সোমেশ্বরানন্দ

ধনতেরস থেকে কালীপূজা- স্বামী সোমেশ্বরানন্দ

================================

ধনতেরস

শব্দটা এসেছে ধন-ত্রয়োদশী থেকে। এই দিনে সমুদ্রমন্থনে আবির্ভূত হয়েছিলেন মা লক্ষ্মী, সম্পদের দেবী। সমুদ্রমন্থনের তাৎপর্য কি? প্রকৃতিতে (ভবসাগর) সবই রয়েছে। কিন্তু বিনা শ্রমে কিছু পাওয়া যাবে না। মন্থন মানে কঠোর পরিশ্রম। কালকূট বিষ থেকে অমৃত, সবই লাভ করা যায়। মা লক্ষ্মী সম্পদ দেন। কিন্তু কেউ তা ভাল কাজে লাগায়, কেউ বা অপপ্রয়োগ করে। সম্পদ পেয়ে মানুষ যাতে অহঙ্কারী হয়ে না ওঠে সেজন্য অনুষ্ঠান ভূত-চতুর্দশীর।

 

ভূত চতুর্দশী

ভূত বলতে কেউ মনে করেন প্রেত, ghost, যেমন ভূত-প্রেত। অন্য অর্থে ভূত মানে অতীত, past, যেমন ভূত-ভবিষ্যত্। এই রাতে ১৪ প্রদীপ জ্বালতে হয়। সাত পূর্ব-পুরুষদের উদ্দেশ্যে ৭ দীপ, আর দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে ৭টি। এর তাৎপর্য? যে সম্পদ লাভ হয়েছে তার ফলে মানুষ যেন অহঙ্কারী না হয়, সম্পদের অপপ্রয়োগ না করে, সেজন্য বিনীত হওয়া। পূর্বপুরুষদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া যে বংশের মর্যাদা রক্ষা করবো। আর দেবদেবীদের আশীর্বাদ চাওয়া এই কাজে।

 

দীপাবলী 

ভূত-চতুর্দশীর পরদিন অমাবস্যায় এই অনুষ্ঠান। দশমীর দিন রাবণ বধ হয়, রাম জয়ী হন। তাই এদিন বিজয়া দশমী। এরপর রাবণের শেষকৃত্য ও বিভীষণের রাজ্য-অভিষেক। ১৮ দিন পরে রাম স্ত্রী ও ভাইকে নিয়ে অযোধ্যায় ফেরেন। তাঁর আগমনের আনন্দে নগরবাসীরা ঘরে-ঘরে প্রদীপ জ্বালায়, সারা অযোধ্যা আলোকিত হয়ে ওঠে। সেই স্মৃতিতেই দীপাবলী আজও।

 

কালীপূজা

○ দীপাবলীর রাতেই কালীপূজা কেন? ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের মধ্যে। বৈদিক ধারার পাশাপাশি যোগ ও তান্ত্রিক ধারা ছিল সুদূর অতীতে। আদিবাসীদের শক্তি উপাসনাকে গভীরে নিয়ে গিয়ে তান্ত্রিক ধারা যে সাধনা গড়ে তুলেছিল তার সাথে মিলন হলো বৈদিক ধারার (অস্ট্রিক বা সাঁওতালদের মধ্যে শক্তি পূজা আজও আছে)। ভারতীয় সংস্কৃতির মূল কথা সমন্বয় —  “একই সত্যকে মনীষীরা নানাভাবে বলেন।”

বৈদিক ধারার দীপাবলী ও তান্ত্রিক ধারার কালী পূজা তাই একই রাতে। দুই নদী মিলে গেল। একে অন্যকে আরও সবল করে তুলে নতুন ধারার সৃষ্টি করলো।

এমনিভাবে বৈদিক ধারার পার্বতী (দক্ষের যজ্ঞ বৈদিক) ও যোগের শিব হলেন স্বামী-স্ত্রী। তন্ত্রের কালী (১০ মহাবিদ্যার প্রথম রূপ) ও যোগের পশুপতি বা আদিনাথও স্বামী-স্ত্রী। ধর্মের মাধ্যমে সব ধারার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ভারতের সংস্কৃতি।

 

দক্ষিণাকালী

মা কালীর দুই রূপ পূজিত। এক, দক্ষিণাকালী —  যে প্রতিমায় মায়ের ডান (দক্ষিণ) পা আগে, শিবের বুকে। মূলত গৃহী সাধক এই রূপের উপাসনা করেন কারণ মা এখানে কিছুটা সৌম্য রূপে।

 

বামাকালী

যে প্রতিমায় মায়ের বাঁ পা সামনে, শিবের বুকে। প্রধানত তান্ত্রিকেরা শ্মশানে এর সাধনা করেন। এই রূপ উগ্র। শক্তি অর্জনে এ বেশি ফলদায়ী, কিন্তু কঠোর সংযম দরকার হয় এই সাধনায়।

 

কালীর ভয়ংকর রূপ কেন?

সুন্দরের মতো অসুন্দরেও মা, ভালোর মতো মন্দেও, সুখের মতো দুঃখেও, স্বর্গের মতো নরকেও, জয় পরাজয়ে, হাসি ও কান্নায়…. মা কালীই তো বিভিন্ন রূপে রয়েছেন সর্বত্র। কিন্তু আমরা শুধু সুখ চাই, আনন্দ চাই, জয় চাই। আর এভাবেই মায়ের সার্বিক রূপকে এড়িয়ে যাই। ফলে আমাদের আধ্যাত্মিক চেতনা অপূর্ণ থাকে।

তাই কালী-উপাসনার অর্থ ভয়ংকরের মধ্যেও মাকে দেখার চেষ্টা। দেওঘরে স্বামী বিবেকানন্দ একবার শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। এক ভদ্রলোক বললেন, আপনি তো ইচ্ছা করলেই এই কষ্ট থেকে মুক্ত হতে পারেন। স্বামীজি উত্তর দিলেনঃ “কেন? এও তো মায়েরই আশীর্বাদ। শুধু স্বর্গ নয়, নরকও তো মায়েরই কোল।”

 

সংগৃহীত: কলমে, ভুবন মোহনকর: পশ্চিম মেদিনীপুর: ১১/১১/২০২৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You cannot copy content of this page

Adblock Detected

Please Turn Off Your Ad Blocker.