বলপাই(সবং) বনেদী ভট্টাচার্য্য পরিবারের সাবেকী পূজোর ইতিকথা
সব্যসাচী গুছাইত
নিজস্ব সংবাদদাতা।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং ব্লক অধীনস্থ বলপাই গ্রামের বনেদী ভট্টাচার্য্য পরিবারের পূজো পারিবারিক পূজো থেকে আজ সার্বজনীন পূজোয় রুপ পেয়েছে। প্রায় দুইশত বছরেরও প্রাচীন এই পূজো। এবছর ২২১ তম বর্ষে পদার্পন করলো।
কথিত আছে ভট্টাচার্য্য পরিবারের পূর্বপুরুষ সত্যচরন ভট্টাচার্য্য রামেশ্বর তীর্থযাত্রার সময় একটি মহিষমর্দ্দিনী মূর্তি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। তিনি সযত্নে বাড়ীতে এনে মূর্তির প্রতিষ্ঠা করে পূজো অর্চনা শুরু করেন। প্রতিমা পূজোর সাথে সাথে আজোও সেই মূর্ত্তি পূজিত হয় এই ভট্টাচার্য্য পরিবারে। শত দারিদ্রতার মধ্যেও ঘটপূজোর মাধ্যমে পূজিত হতো মহিষমর্দিনী মূর্ত্তি। প্রথম থেকেই আশেপাশের পূজোর থেকে এই বাড়ীর পূজো একটু ভিন্নধর্মী ছিলো। পূজোয় আড়ম্বরতা ছিল না। পূজোকে কেন্দ্র করে
নরনারায়ন সেবায় জোর দিতেন এই পরিবার।
পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের সদস্য ও আত্মীয়রা কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পারিবারিক ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে প্রথম ২০০১ সালে প্রতিমা পূজো শুরু করেন। পূজোকে কেন্দ্র করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক কাজই ছিলো মূল লক্ষ্য। সপ্তমীতে শিক্ষা সংক্রান্ত তথা আশেপাশের ছাত্রছাত্রীদের বই, স্কুলব্যাগ, পোষাক বিতরন, অষ্টমীতে স্বাস্থ্য শিবির, নবমীতে দুস্থ মানুষদের বস্ত্র বিতরন, দশমীতে বৃক্ষ রোপন ও ফলের চারাগাছ বিতরন করা হয়। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের পাত পেড়ে নরনারায়ন সেবার দায়িত্ব নিতেন এই ভট্টাচার্য্য পরিবার। খাওয়ার পর এঁটো পাতা তুলতে দিতেন না। নিজেরা আন্তরিকতার সাথে করতেন। এই ট্রেডিশান বর্তমান উত্তরসূরীদের মধ্যে আজও বিদ্যমান।
এই পরিবারের বড় কর্তা তথা বলপাই পশুপতি সুরেন্দ্র বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক কৃষ্নকুমার ভট্টাচার্য্য বয়সের কাছে হার মানেননি। পরিবারের ঐতিহ্য ধারাবাহিকতাকে ধরে রাখতে এবছরের পূজোর সব দায়িত্ব দেখভাল করছেন তিনি নিজেই। তিনি জানান- ২০১৯ সালে সবং ব্লকের চকদামুসেন গ্রামের এক আদিবাসী অধ্যুসিত এলাকায় বিভিন্ন ফলের চারাগাছ নিজের হাতে লাগিয়ে এসেছেন। ওই এলাকাকে সাজিয়ে তোলার আরোও অনেক পরিকল্পনা আছে।
পূজোকে কেন্দ্র করে পরিবারের সবাই আত্মীয়রা দূরদূরান্ত থেকে এসে মিলিত হয় এই কয়েকদিন।
বর্তমান প্রজন্মের উত্তরসূরী গৌতম ভট্টাচার্য্য বলেন- “পারিবারিক পূজো হলেও আমরা এই পূজোকে সার্বজনীন রুপ দেওয়ার বরাবরই চেষ্টা করেছি। বর্তমানে গ্রামবাসী ও এলাকার মানুষজন এই পূজোয় সবাই স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহন ও সহযোগীতা করে”।
এই পরিবারের সর্বময় কর্ত্রী ছিলেন রুনু ভট্টাচার্য্য। কলিকাতার মেয়ে হলেও, কলিকাতার বৈভবপূর্ন পূজো ছেড়ে এই পারিবারিক পূজোয় নিজেকে সমর্পিত করতেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি পরলোক গমন করায় পরিবারের সবার মধ্যে শোকের ছায়া। তাই এবছর পূজোয় থাকবেনা কোন আড়ম্বর, থাকবে না কোনো আতসবাজীর শব্দ। থাকবে না আলোকসজ্জ্বা। নরনারায়ন সেবার উপরেই জোর দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই পরিবারের ভাগ্না তপন ভট্টাচার্য্য। তিনি বলেন- প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষের সেবার সুযোগ পাবো, এটা আমাদের কাছে পরম প্রাপ্তি”। পরিবারের বেশীরভাগ সদস্য কর্মসুত্রে বাইরে থাকায় মূলত প্রতিমা বা মূর্ত্তি পূজোর পুরো দিকটাই দেখভাল করেন তপনবাবু নিজেই।
বর্তমানে সবং ব্লকের মধ্যে ঐতিহ্যশালী বনেদী বাড়ীর পূজো হিসেবে পরিনত হয়েছে এই পূজো। আশেপাশের বহু মানুষ ভীড় করে পূজো মন্ডপে। সুষ্ঠ ভাবে পূজো সম্পন্ন করার জন্য পরিবারের সদস্য সদস্যাদের সাথে দায়িত্ব নেয় গ্রামের মানুষজন।
পরিবারের সদস্য অলক ভট্টাচার্য্য জানান- বর্তমান বছরে দুস্থদের বস্ত্র বিতরন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির, স্বর্গীয়া রুনু ভট্টাচার্য্য স্মৃতি রক্তদান শিবির, ফলের চারাগাছ বিতরন সহ বিভিন্ন সেবামূলক কর্মসূচীর উপর জোর দিয়েছেন পরিবারের মানুষজন।
জানা যায়, এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন সবং ব্লক সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক, বিশিষ্ট শিশু চিকিৎসক ডাঃ বি. বি. মন্ডল, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, পিংলা কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ সুকুমার চন্দ্র সহ একাধিক গুনীজন।
পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদবার্তার মধ্য দিয়ে সবাইকে আমন্ত্রন জানানোর কথা বলার ভূল করেননি পরিবারের বড়কর্তা কৃষ্নকুমার ভট্টাচার্য্য।